আপনি কি লগআউট করতে চান

জামিল, আরাফকে ওর ফুপুর কথা আগেও বলেছে। এতোবার বলেছে যে, শুনে শুনে আরাফের মনের মধ্যে জামিলের ফুপুর একটা কাল্পনিক ছবি তৈরি হয়ে গেছে।

ঢাকা থেকে নবাবগঞ্জ খুব বেশি দূরে না হলেও রাস্তার কারণে পৌঁছতে মোটামোটি সময় লাগে। গাড়ি চালাতে চালাতে আরাফের মনে হলো বাড়ি থেকে বের হবার সময় বাবাকে বলা হয়নি। না বললেও হয়। যেহেতু বাবা খুব সকালে বেরিয়েছে, তার মানে তাঁর ব্যস্ততা আছে। তাছাড়া আরাফের তো বিকেলের মধ্যেই ফেরার কথা। তারপরও কী মনে করে সে কুতুবুদ্দীনকে ফোন করে।
কুতুবুদ্দীন সাহেব তখন সচিবের সাথে জরুরি একটা মিটিংএ ছিলেন। তবু ধরলেন। একমাত্র ছেলে বলে অথবা পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য বলে কিনা কে জানে! আরাফ এতসব ভাবেনা। যখন ইচ্ছা কথা বলে। প্রায় সময়ই অবশ্য ফোনেই কথা হয়। মুখোমুখি দেখা হয় খুবই কম।
‘বাবা, ব্যস্ত?’
কুতুবুদ্দীন সাহেব সবসময়ই গম্ভীর। যদিও আরাফ জানে এটা তাঁর একটা মুখোশ। তিনি ওপাশ থেকে বলেন, ‘অসুবিধা নাই। বলো। কোন সমস্যা?’
আরাফ তার নবাবগঞ্জ যাওয়ার কথাটা জানিয়ে ফোন ছেড়ে দেয়।
ব্রিজ, রাস্তা এসব হওয়ার পর এলাকাটার চেহারা পাল্টে গেছে। নতুন নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা দেখা গেছে। জমির দামও আকাশছোঁয়া। রাতারাতি বড় বড় দালান, ফ্যাক্টরি গড়ে উঠছে। আর এসবের জন্য চাই নির্মাণ সামগ্রী, বিশেষ করে ইট। জামিল একটা ব্রিকফিল্ড করতে চায়। কিছু জমিতো আছেই। কিন্তু ওর ইচ্ছা বড় করে কিছু করার। সমস্যা হয়েছে পৈত্রিক জমির একপাশে ফুপুর একটুকরো জমি। জামিল কিনে নিতেও রাজি। কিন্তু ফুপু দিবেনা। তাই সে আরাফকে নিয়ে যাচ্ছে।
জামিলের ধারণা ভাইয়ের ছেলে বলে ফুপু জমিটা ছাড়ছে না। আরাফকে তাই ক্রেতা সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভালো দাম বলা হবে। প্রয়োজনে আরাফই ফুপুকে ভয় দেখাবে। বিক্রি করতে বাধ্য করবে। কাজটা ওর জন্য তেমন কঠিন কিছু নয়। এর আগেও এরকম ভয় দেখিয়ে অনেককে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেছে সে।
জামিলের বাড়িতে নাস্তা করে ওরা ফুপুর জমিটা দেখতে যায়। পুরো জঙ্গল। মাঝখানে একটা ঢিবি। সাপ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আরাফ আর এগোয় নি। জামিল এদিক সেদিক ফুপুর খোঁজ করে।
‘পাগল তো, কই কই ঘুরে বেড়ায়! দাঁড়া খুঁজে দেখি।’
জামিল যাওয়ার পর আরাফও দূর থেকে জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শান্ত প্রকৃতি। গাছে গাছে পাখিদের চেচামেচি। আরাফের কেমন ঘোর লাগে। সে চোখের সামনের বাস্তবতা বিস্মৃত হয়। কল্পনায় দেখে বিশাল এক দোতলা বাড়ি। চারপাশে প্রচুর গাছপালা। দোতলার বারান্দায় সে নিজেকে দেখে রেলিংএ ঝুঁকে দূরে তাকিয়ে কী দেখছে। হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। পাশে ওর গা ঘেঁষে মিষ্টি একটা মেয়ে। ওটা কে! ওর বউ? এবার সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়েটাকে দেখে। চেনা কেউ কী!
‘বদের বদ। বাইরাইয়া তর শখ ছুটায়া দিমু। যাহ। যাহ এখান থিকা..’
আচমকা ধমকে আরাফের কল্পনা ছুটে যায়। সে চমকে তাকায়। দেখে বয়স্কা এক নারী। চুল পরিপাটি, বাঁধা। পরনের শাড়িটাও গুছিয়ে পড়া। শুধু পা খালি। এটাই বিসদৃশ। আরাফ ভদ্রমহিলার মুখটা তেমন লক্ষ্য করেনা। কিছুটা সম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। ভদ্রমহিলা এসব দেখেনা। এমনকি আরাফকেও না। পিছনে তাকিয়ে কাকে যেন বকতে থাকে। কিন্তু তাঁর পিছনে আর কাউকে আরাফ দেখতে পায়না। ভদ্রমহিলা অদৃশ্য কাউকে বকতে বকতে পথ ছেড়ে নিচে নামে। তারপর আরাফের প্রায় পাশ ঘেঁেষই জঙ্গলের দিকে চলে যায়। আরাফ মনে মনে ভাবে পাগল নাকি? এও ভাবে- এই গ্রামে পাগলের সংখ্যা কি একাধিক! জামিলের ফুপু আর এই ভদ্রমহিলা, দু’জনতো হলোই। নিশ্চয়ই আরো কেউ আছে!
আরাফের ধারণা, বাংলাদেশের সব গ্রামেই একজন করে পাগল থাকে। তাদের সবাই অবশ্য পুরুষ। জামিলদের গ্রামে অন্তত দু’জন। এবং দু’জনই মহিলা। আরাফ মনে মনে এসব ভাবে। তারপর জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে আবার ছিঁড়ে যাওয়া কল্পনার ছবিটা জোড়া দিতে চেষ্টা করে। কাজ হয়না। আরাফ চোখের সামনে শুধু সামনের জংলা যায়গাটাই দেখতে পায়।
‘ধুৎ।’
পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট পায়না। গাড়িতে ফেলে এসেছে। আরাফ জামিলদের বাড়ির দিকেই যায়।
গাড়িতে বসে সিগারেট খেয়ে ঘরে গিয়ে বসে। জামিলের বউ এসে কথাটথা বলে। গ্রামের হলেও মেয়েটার সহবত ভালো। দেখতেও বেশ মিষ্টি। আরাফ একটু আগের কল্পনায় দেখা মেয়েটার সাথে মিলিয়ে দেখে। না। মেলেনা। তবু জামিলের নতুন সংসার দেখে কেমন একটা শূন্যতার বোধ হয় আরাফের।
‘আপনার ঢাকা যেয়ে থাকতে ইচ্ছা করেনা?’
জামিলের বউ বলে, ‘না। এখানেই বেশ আছি। তাছাড়া ও তো প্রায়ই এসে থাকে।’
আরাফ আর কথা খুঁজে পায়না। সামনের দেয়ালে টাঙানো জামিলের বাবার ছবি দেখে। অতি সাধারণ চেহারা। মনে মনে নিজের বাবার সাথে মিলিয়ে দেখে। একেবারেই মেলেনা।
‘চা খাবেন ভাইয়া?’
জামিলের বউয়ের কথায় আরাফ আবার বাস্তবে ফেরে। মাথা নেড়ে না বলে।
‘খালু মারা গেলেন কত বছর হলো?’
‘দশ বছর।’
‘দশ বছর! এতোদিন পর এলাম?’
‘হ্যা। আমাদের বিয়েতেওতো আসেননি আপনি।’
মেয়েটার মুখের হাসিটাও ঝকঝকে। আরাফের ভালো লাগে। এবং এই প্রথম অবাক হয়ে লক্ষ্য করে জামিল অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। যার ছবি আগে দেখিয়েছে এ সে নয়। তার মানে কী! যার সাথে প্রেম ছিলো জামিল শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করেনি! আরাফ আরেকটা জিনিষ লক্ষ্য করলো নিজের কল্পনায় এতক্ষণ সে জামিলের প্রেমিকাকেই দেখেছে। আরাফের কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো।
‘আমি জানি আপনি রায়ানার কথা ভাবছেন।’ জামিলের বউয়ের কথায় আরাফ চমকে তাকায়।
‘না ঠিক তা নয়।’
‘শুনুন আরাফ ভাই, এই পরিবারের কথাতো আপনি জানেনই। এখানে দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত কারো মেয়ে বউ হিসেবে আসবে তাও কি সম্ভব? রায়ানার দোষ ওইটুকুই। আর জায়গা খালি দেখে আমি সুযোগটা নিয়েছি’ মুখের হাসিটা ধরে রেখেই জামিলের বউ বললো, ‘রায়ানার বাবার বিষয়টা ও আগে জানতো না।’
‘জামিল মেনে নিলো!’
‘নিয়েছে বা মানতে বাধ্য হয়েছে। ওসব আমি ভাবিনা। আমি আপনার বন্ধুকে ছোটবেলা থেকেই মনে মনে চাইতাম। আপনার কি মনে হয়না এখন ও আমাকে পছন্দ করে? একদিন ভালোও বেসে ফেলবে, আমি জানি।’
আরাফ কিছু বুঝতে পারেনা। ‘সরি ভাবী, আপনার নামটা যেন জামিল কী বললো..’
‘আঁখি। আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকেন।’
আরাফের অস্বস্তি কাটেনা। সে উঠে জামিলের বাবার ছবির সামনে যায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর আঁখিকে দেখে। চোখ ঘুরিয়ে জামিলের গ্রামের বাড়ির বসার ঘর দেখে।
‘আঁখি, একটা মেয়ে খুঁজে দেননা, বিয়ে করি।’
আঁখি হাসতে হাসতেই বলে, ‘সেটা এভাবে বললে হবে? আত্মীয়-বন্ধু সবাইকে বলেন। তাছাড়া এই গ্রামগঞ্জে আপনি..
বাইরে জামিলের গলা শুনে ওদের কথা থামে। আরাফ দেখে জামিল একটু আগে দেখা ভদ্রমহিলাকে হাত ধরে নিয়ে আসছে।
‘ফুপু, এই হচ্ছে আরাফ। আমার বন্ধু।’
ফুপু! ইনিই তাহলে জামিলের পাগল ফুপু! কিন্তু আরাফের কাছে এঁকে পাগল বলে মনে হয়না। তার এতদিনের কল্পনার পাগল ফুপুর সাথে এঁর কোনই মিল নেই।
ফুপু শান্তভাবে ঘরে এসে দাঁড়ান। আরাফের দিকে চোখ তুলে তাকান। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। আরাফ চমকে যায়। বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। কান্না থামলেও ফুপু আরাফকে ছাড়েনা। জামিল আর আঁখি ব্যস্ত হয়ে ওদেরকে সোফায় বসায়। পাশাপাশি বসে ফুপু ওর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আর আরাফ তন্ময় হয়ে ভদ্রমহিলার মুখ দেখতে থাকে।
আরাফ কিছু বুঝতে পারেনা। ও নিশ্চিত ইনি তার মা নন। মায়ের অসুস্থতা আর মৃত্যু- এইতো সেদিনের কথা! এমনকি কবর দেয়ার সময়টাও সে স্পষ্ট মনে করতে পারে। তাছাড়া বেঁচে থাকলেও মায়ের বয়সটা জামিলের ফুপুর থেকে অনেকটাই কম হতো। কিন্তু দু’জনের চেহারার কী আশ্চর্য মিল! আরো আশ্চর্য, জামিলের ফুপুও আরাফকে তাঁর ছেলে মনে করছেন! আরাফ বুঝতে পারেনা সে কেন ওঁর একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে!
ফুপুর বয়স হয়েছে। সারাদিন এদিক সেদিক রোদ বৃষ্টি মাথায় করে ঘোরেন। জামিল বা আঁখি খেয়াল করে না খাওয়ালে ওঁর খাওয়াও হয়তো হয়না। তাই যতœ পেয়ে আরাফের একটা হাত ধরে সোফাতেই ঘুমিয়ে পরলেন। সাবধানে হাতটা ছাড়িয়ে আরাফরা ওখান থেকে উঠে এলো একটু পর।
জামিল কী ভাবছে কে জানে। আঁখিই কথা শুরু করলো।
‘আপনি কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। জানেনতো সবকিছু। উনি আপনাকে তাঁর ছেলে মনে করছেন।’
‘না না ঠিক আছে। কিন্তু জামিল, তুইতো কখনো বলিসনি ওঁর ছেলে আছে!’
এবার জামিল বলে, ‘থাকলেতো বলবো।’
‘তাহলে কি এটাও ওর পাগলামি?’
‘ছোটবেলায় শুনেছি ওঁর মৃত ছেলে হয়েছিলো। ওই ভিটির পাশেই ওর কবর। কিন্তু ওঁর ধারণা ছেলেটা বেঁচে আছে। কোথাও হয়তো লুকিয়ে আছে বা হারিয়ে গেছে।’আঁখি বললো।
‘তাই কি উনি ওঁর জমিটা বেঁচতে চাননা?’ আরাফ জানতে চায়।
‘তা জানিনা, ভাইয়া। তবে ভিটিটা নিয়ে আরেকটা গল্প আছে, জানেন?’
‘নাতো। কি?’
‘আমার বাবা, শ্বশুর সহ গ্রামের অনেক তরুণ-যুবকই তখন বর্ডারের ওপাড়ে। ফুপুর কেবল বিয়ে হয়েছে। এক রাতে নাকি ফুপা চুপিচুপি এসে ফুপুকে একটা কিছু লুকিয়ে রাখতে বলে। যাওয়ার আগে বলে যায় মাসখানেকের মধ্যে এসে ফুপুকেও ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে। তারপর আর আসেনি।’
‘ফুপু কি সেটা ওই ঘরেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন?’
‘হ্যা।’
‘কী সেটা?’
‘পতাকা। ঘরের মেঝে খুড়ে ফুপু সেটা লুকিয়েছিলেন।’জামিল বলে।
আরাফের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ‘মাই গড। আর এতোটা বছর উনি সেটাই আগলে আছেন?’
কেউ কোন কথা বলেনা। থেকে থেকে কাঠঠোকরার গাছ কোড়ানোর শব্দ পাওয়া যায়।

© ২০২৪ লেখারপোকা | সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত

ট্রেড লাইসেন্স ঃ TRAD/DSCC/217680/2019