প্রবন্ধ
বিশ্ব মানবাধিকার দিবস স্মরণ
আবদুল্লাহ আল মোহন
১. বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আজ মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর)। ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ এখনই’—এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সালে এই দিনটিকে জাতিসংঘ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে এ দিনটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার’। দিবসটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে মানবাধিকার কমিশনসসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। মানবাধিকার সনদ (Universal Declaration of Human Rights (UDHR)) একটি ঘোষণাপত্র। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই ঘোষণা প্রদান করা হয়। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সনদ ঘোষিত হয়। অনেক রক্ত ঝরা স্মৃতি নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ফ্যাসিবাদ তথা নাৎসিবাদের ভয়াবহ স্মৃতি তখনও টাটকা। বিজয়ী মিত্রশক্তিসমূহ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি যেন ফিরে না আসে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ দরকার, ক্ষমতা যেন কখনও দৈত্য না হয়ে বসে। অতএব, মানুষের অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রসঙ্ঘের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত। বহু প্রতিনিধির অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহীত হল মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা। সর্বমোট ৩০টি অনুচ্ছেদে উল্লেখিত হল মানুষের রাজনৈতিক, নাগরিক অধিকারই শুধু নয়- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারগুলিও। জাতিসংঘের কোনও সদস্য-রাষ্ট্র এই ঘোষণার কোনও বিরোধিতা করেনি আজ পর্যন্ত। নৈতিক ভাবে স্বীকার করে নিয়েছে, স্ব-স্ব দেশে নাগরিকদের এই সমস্ত অধিকার প্রাপ্য। এগুলির নিরবচ্ছিন্ন বাধাহীন প্রয়োগেই সম্ভব নাগরিকদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাটি ‘সকল জাতির এবং মানুষের অর্জনের সাধারণ মান’ হিসেবে গৃহীত হয়। যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে এটি গৃহীত হয় তা হলো ‘সকল মানুষই বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের বুদ্ধি ও বিবেক দেয়া হয়েছে এবং তাদের উচিত ভ্রাতৃসুলভ মনোভাব নিয়ে একে অন্যের প্রতি আচরণ করা।’
২. সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে মানবাধিকার। মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সম্ভব একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজগঠন যা সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করবে। এই অধিকার বলতে আমরা বোঝাতে চাই বেঁচে থাকার অধিকার, খাদ্য অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, শান্তি ও সাম্যের অধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অধিকার, মান ও সম্মানের অধিকার, নারী অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার এবং সার্বিকভাবে সমঅধিকার ভিত্তিক একটি সমাজে শান্তিময় জীবনযাপনের অধিকার। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা (ইউডিএইচআর) সহ বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট চুক্তি এবং সনদের অন্যতম স্বাক্ষরকারী সদস্য। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মানব পরিবারের সকল সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহ এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। আমরা সবাই এমন একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রত্যাশা করি যেখানে মানবাধিকারের আলোকে সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেনী, পেশা, গোষ্ঠী, লিঙ্গ ভেদে সমাজের সকল স্তরের বিশেষত অবহেলিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনগনের সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে দেশের প্রতিটি জেলায় সাংবাদিকদের মাঝে অধিকতর জনসচেতনতায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)। এই সংগঠনটির প্রশিক্ষণমূলক নানা কাজের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্টতার সুযোগে মানবাধিকার নিয়ে তাদের দৃশ্যমান ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা না করলেই নয়। মানবাধিকার দিবসে তাই এই সংগঠনের প্রধান নির্বাহী জনাব খায়রুজ্জামান কামাল সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
৩. মানবাধিকার– একটি শব্দ, একটি অধিকার। বিশ্বায়নের এই যুগে অসংখ্যবার মানবাধিকার শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে পৃথিবীর সব মানুষের জীবনে৷ অধিকার, মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকার বিষয়ে সামান্য ধারণা স্পষ্ট করা যাক। অধিকার বলতে বুঝি সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি ন্যায্য দাবী যার স্বীকৃতি মেলে তাই অধিকার। আমরা জানি, অধিকার হচ্ছে মানুষের আত্মবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার দাবী, যা নৈতিক নয়তো আইনগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আইন বিজ্ঞানী সেমন্ড খুব সহজ করে বলেছেন ‘আমার জন্য অন্যদের যা করতে হবে সেটাই আমার অধিকার। আইন থেকে অধিকারের সৃষ্টি হয় না। সমাজে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অধিকারের জন্ম হয়। কোন আইন কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটা থাকে নৈতিক অধিকার। আর আইন স্বীকৃতি দিলে হয়ে যায় আইনগত অধিকার। ব্যাপক অর্থে অধিকার তাই দুভাগে বিভক্ত – ক. নৈতিক অধিকার খ. আইনগত অধিকার। আর নৈতিক অধিকার হলো যে অধিকারের ভিত্তি নৈতিকতা এবং যা ভংগ করলে নৈতিক অপরাধ হয় তাকে নৈতিক অধিকার বলে। যেমন- সন্তানের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পাওয়ার নৈতিক অধিকার মাতা-পিতার রয়েছে। আইনগত অধিকার হলো যে অধিকার দেশের আইন দ্বারা স্বীকৃত এবং যা ভংগ করলে আইনগত অপরাধ হয় তাকে আইনগত অধিকার বলে। যেমন-ঋনদাতার ঋণের টাকা ফেরত পাবার অধিকার। মানবাধিকার হচ্ছে মর্যাদার দাবী। অর্থাৎ, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারই হচ্ছে মানবাধিকার। অপর কথায় যে অধিকার সহজাত, সার্বজনীন, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অখন্ডনীয় তাই মানবাধিকার। আর মৌলিক অধিকার হচ্ছে যে অধিকার গুলো সংবিধানে স্বীকৃত এবং আদালতের মাধ্যমে কার্যকরযোগ্য তাই মৌলিক অধিকার ।প্রকৃত অর্থে সব মৌলিক অধিকার মানবাধিকার কিন্তু সকল মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নয় ।
৪. মানবাধিকার মানবাধিকারের ধারণাটি আঠারো শতকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকালের ফসল। তবে সমসাময়িক মানবাধিকারের ধারণার উদ্ভব ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। বিখ্যাত আইনবিদ Louts Henkin তাঁর ''The International Bill of rights'' গ্রন্থের ভূমিকাতে মন্তব্য করেছেন যে, ''Human Rights is the idea of our time'' অর্থাৎ মানবাধিকার হলো বর্তমান কালের ধারণা। ইংল্যান্ডে মানবাধিকার বিকাশের পথ পরিক্রমার চারটি পর্যায় হল ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস ১৬৮৮ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৭০১ সালের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট। ১৭৮৯ সালে French declaration of rights of man and of the citizen অর্থাৎ মানুষ ও নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত ফ্রান্সের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়। ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ঘোষিত মানবাধিকারের আলোকেই এটি প্রণীত হয়। ১৭৮৯ সালের এই ঘোষণা এবং ১৭৯১ সালের ফ্রান্সের রেনেসাঁ উত্তর প্রথম সংবিধানে যে সকল অধিকার প্রদান করা হয় সেগুলো হলো, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, আইনের চোখে সমান অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি ইত্যাদি। আবার পাশ্চাত্যের আইন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ওপর আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, তাদের মানবাধিকারের ইতিহাস বড় জোর ১২১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ইতিহাস এবং এ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা মানুষের অধিকারসমূহকে স্বীকার করেনি। এ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য শত শত বছরব্যাপী রক্ত ঝরাতে হয়েছে। আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মানবাধিকারের সার্বজনীনতায় তারা বিশ্বাস করতেন না, আন্তরিক ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পাশ্চাত্যে মানবাধিকার সংক্রান্ত যে সকল দলিল আমরা পাই, সেগুলোর কোনটিই আন্তর্জাতিক তথা সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন ছিল না। বলা হয়ে থাকে, The charter of the United Nations Organisation has internationalised the idea of human rights.'' অর্থাৎ মানবাধিকারের ধারণাটির আন্তর্জাতিককরণ করেছে, জাতিসংঘ সনদ।'' সকলেই এটি স্বীকার করেন যে, জাতিসংঘ সনদ (১৯৪৫)-এর আগে মানবাধিকারের ধারণাটি বিশ্বজনীন ছিল না। মৌলিক অধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ (ইউডিএইচআর)-এর মাধ্যমে, যা ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। তবে মানবাধিকারের আলোচনা বিশ্বব্যাপি প্রসার লাভ করে বিশ শতকের চল্লিশ থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। বর্তমানে যেকোন বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের ধারণা একটি প্রাথমিক কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।
৫. মানবাধিকার শব্দটিকে ভাঙ্গলে দু'টি শব্দ পাওয়া যাবে।একটি মানব,অন্যটি অধিকার। মানবাধিকার শব্দের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে মানুষের অধিকারকে। তাহলে মানবাধিকার হলো মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার গুলোকে বুঝায়। সহজ ভাষায় মানবাধিকার হচ্ছে মানুষের সহজাত অধিকার যা যে কোন মানব সন্তান জন্মলাভের সাথে সাথে অর্জন করে। মূলত যে অধিকার মানুষের জীবন ধারনের জন্য,মানুষের যাবতীয় বিকাশের জন্য ও সর্বপরি মানুষের অন্তরনিহিত প্রতিভা বিকাশের জন্য আবশ্যক তাকে সাধারনভাবে মানবাধিকার বলা হয়। জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার অধিকার এবং মতামত প্রকাশের অধিকার,অন্ন বস্ত্র ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার,ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অংশগ্রহণের অধিকার প্রভৃতি সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে মানবাধিকার বলতে পারি। মানবাধিকারের আলোচনার ক্ষেত্রে বার বার বলা হচ্ছে,প্রতিটি মানুষের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হবে এবং সেই সঙ্গে সমানাধিকারও নিশ্চিত করা হবে৷ কিন্তু এত প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞার পরও মানবাধিকার আজ হুমকির সম্মুখীন৷ উন্নয়ন, প্রযুক্তির অগ্রগতি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা, ব্যবসা এবং শ্রম বাজার নীতি এবং কৌশল পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মানুষের জীবন পাল্টে দিয়েছে৷ উপরোক্ত প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন যে জড়িত, তা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কারণ পৃথিবীর সব মানুষই স্বাধীন৷ সবার আছে সমানাধিকার৷ সভ্য সমাজে থাকতে হলে যে অধিকারের প্রয়োজন তার প্রতিটিই প্রত্যেকটি মানুষের উপভোগ করার অধিকার রয়েছে– এই কথাগুলো বলা হয়েছে ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে৷ কিন্তু নশ্বর এই মাটির পৃথিবীতে আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে৷ প্রকৃতি, পরিবেশ এবং সমাজে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা৷ অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি দেশ৷ আবহাওয়া ও পরিবেশ পরিবর্তনের খেসারত দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো৷ পানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের চূড়ান্ত ব্যবহার করার ফলে এগুলো এখন হুমকির সম্মুখীন৷ গত দশ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে৷ কোনো কোনো জায়গায় তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে৷ কারণে-অকারণে দেখা দিচ্ছে সংঘাত-সংঘর্ষ৷ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে যা কমাতেই হবে ।
৬. মানবাধিকার বলতে বোঝায় মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা যা সকল মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। প্রচলিত ধারণায় এই অধিকারগুলো হচ্ছে অখন্ডনীয় এবং মৌল। তবে এ সকল অধিকার এবং স্বাধীনতা যেসব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হোক, তা থাকবে বিতর্কের জন্য উন্মুক্ত। তাই দেখা যায় যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এবং নাগরিক অধিকার (যা প্রথম প্রজন্মের অধিকার বলে বিবেচিত) বেশি সুবিধা দিচ্ছে বলে অনেকে প্রাধান্য দেন, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারকে (যা দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকার বলে বিবেচিত) অনেকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার গুরুত্ব দিচ্ছেন যে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত মানবাধিকার নির্ধারিত হয়নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মাধ্যমে এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নাও হতে পারে। প্রাকৃতিক অধিকার থেকে মানবাধিকার মানব ইতিহাসের ব্যাপক পরিসরে দেখা যায় যে, কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার, দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ রূপলাভ করে সমাজের সদস্য হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট দল বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং সে প্রতিষ্ঠান হতে পারে পরিবার, সম্প্রদায়, ধর্ম, পেশাগত গ্রুপ ইত্যাদি। ব্যক্তি হিসেবে প্রতিটি মানুষ তার মানব অস্তিত্বের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে মানবাধিকার পাওয়ার যোগ্য, এ ধারণাটি সাম্প্রতিক হলেও বহুপূর্ব থেকে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা এবং প্রধান ধর্মীয় অনুশাসনের মূলে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
৭. ঐতিহাসিক কাল থেকেই সর্বজনীন মানবাধিকারের ভিত্তিমূল হিসেবে প্রাকৃতিক আইনকে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক নিয়মাবলি বজায় রাখার ক্ষেত্রে যেসব সংগঠক রয়েছে তা বিভিন্ন সময়ে এবং পরিসরে ধর্মীয় এবং নৈতিক অবস্থান হতে জৈবিক ও সামাজিক রীতিনীতির স্থিরতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকগণ প্রাকৃতিক অধিকার এবং ন্যায়নীতি প্রসঙ্গে পরিস্কার ধারণা দেন, যা মূলত প্রাকৃতিক আইন হতে উদ্ভূত এবং বিশ্বে বিদ্যমান প্রাকৃতিক নিয়ম-শৃঙ্খলা থেকে বিকাশ লাভ করেছিল। এই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার একটি ঐশ্বরিক ভিত্তি ছিল যা সৃষ্টিকর্তা বা বিধাতার ইচ্ছা হিসেবে ধরা হয়। এ ব্যাপারে একটি পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায় সার্বভৌম প্রাকৃতিক অধিকারের ধারণা হতে, যা সতেরো এবং আঠারো শতকের ইউরোপের বহু দার্শনিক তাদের লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এখানে তাঁরা মত প্রকাশ করেন যে, অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট উদ্যোগে সমষ্টিগতভাবে রাষ্ট্রে প্রকাশ পেয়েছে। সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রণেতা তত্ত্ববিদগণ প্রাকৃতিক আইনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে একে বিস্তৃত করে মানব সম্প্রদায়ের প্রাকৃতিক অধিকারকে আরো সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
৮. আঠারো শতকের দার্শনিক জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিস্তৃতির দ্বারা সামাজিক চুক্তি মতবাদের যে নতুন ধারা তৈরি হয় তা পরবর্তীতে মানবাধিকার তত্ত্বের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদে রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পাদিত দ্বিতীয় চুক্তিতে (১৬৮৯) তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বিধাতার বা প্রকৃতির সৃষ্টি হিসেবে প্রতিটি মানবসত্তা প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন এবং সমঅধিকার সম্পন্ন। সুতরাং জনগণের প্রাকৃতিক অধিকার ছিল, এবং প্রাকৃতিক আইন ব্যবহার করে তারা জীবনের এবং সম্পত্তির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ভোগ করত। কাল্পনিকতা সত্বেও লকের প্রাকৃতিক অধিকারের ধারণা আধুনিক ধারার অধিকারের ধারণার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এক্ষেত্রে ১৭৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের উল্লেখ করা যায় যেখানে প্রাকৃতিক অধিকারের মতবাদ গ্রহণ করে বলা হয়েছিল, সকল মানুষ সমভাবে সৃষ্ট হয়েছে এবং সেই সাথে প্রকৃতিগতভাবে অখন্ডযোগ্য কিছু অধিকার লাভ করেছে যার মধ্যে রয়েছে জীবন,স্বাধীনতা এবং সুখের অনুসন্ধানের মতো অধিকার।
৯. সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভের অল্প কিছুদিনের মধ্যে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রাথমিক ভিত্তির দলিলটি গৃহীত হয়। বাধ্যবাধকতাহীন এই দলিলে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একনায়ক সুলভ ক্ষমতার ব্যবহার থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মানবাধিকারের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল। বিশ্বের সবগুলো মহাদেশের এবং ধর্মের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচিত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির দ্বারা গবেষণার মাধ্যমে এবং প্রতিটি অধিকার আলাদা অংশে বিভক্ত করে সর্বজনীন মানবাধিকার তত্ত্বটি প্রস্ত্তত হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার তত্ত্বে মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, যা সমগ্র মানব সত্তার সাথে জড়িত। ইউডিএইচআর-এর ১ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে যে, সকল মানুষই স্বাধীন অবস্থায় সম-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এর সাথে যোগ করা হয়েছে অর্থনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার। সব অধিকারের সমন্বয়ে প্রণীত ইউডিএইচআর-এ আশা করা হয়েছিল যে, মৌলিক অধিকারসমূহ অবিচ্ছেদ্য এবং অলঙ্ঘনীয় ভাবে তৈরী। ইউডিএইচআর-এ ঘোষিত মানবাধিকারের ধারণা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে কখনও পূর্ণ সমর্থন পায়নি, এমনকি পরবর্তীতে এ ধারণার বিপক্ষে তাদের কাছ থেকে আপত্তিও এসেছে। বছর পরিক্রমায় বিভিন্ন কভেন্যান্টস এবং সনদ দ্বারা ইউডিএইচআর-এ বর্ণিত মানবাধিকারের ধারণার পরিসর বৃদ্ধি পেয়ে কাঠামোগতভাবে আরো বিস্তৃত হয়েছে বিভিন্ন যৌথ অধিকার এবং অ-রাষ্ট্রীয় সংগঠক বিশেষ করে বহুজাতিক কর্পোরেশন সমূহের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে।
১০. সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার দ্বারা কে অধিকার ভোগ করবে এবং সেটা কোন প্রকার অধিকার তা নির্ধারণ করা হয়নি। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে উপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কঠোর আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এ প্রশ্নও উঠে আসে যে অধিকার কার, এবং কোনো নারী বা পুরুষ কী ধরণের অধিকার লাভ করবে। ফলে এ সময়ে অধিকারের এই দুই ধরণের ধারণার সমন্বয়ে নতুন একটি ধারা তৈরী হয় (Lauren-in-Cimel)। কোনো একটি মৌলিক মানবাধিকার কিভাবে অর্জিত হয় এবং কোন অংশটি অহস্তান্তরযোগ্য, এই দুটির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হয় উপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে। মূলত এ আন্দোলন জাতিগোষ্ঠী এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার বিরোধকে উদারমতাবলম্বী অধিকারের আন্দোলনের ধারণা দ্বারা সুদৃঢ় করে তোলে।
১১. মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিতর্কে জাতীয়তাবাদীরা ব্যক্তি অধিকারের চেয়ে কোনো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে বেশী প্রাধান্য দেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, উপনিবেশবাদ বিরোধী কর্মী নাইজেরিয়ার মবোনু ওজিক দাবি করেন যে, মাতৃভূমিতে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ব্যক্তির একটি প্রাকৃতিক অধিকার। হো চি মিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণাকালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণায় বিধৃত জনগণের অনন্য-সমর্পনীয় অধিকারের উদ্ধৃতি দেন। পশ্চিমা দেশগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৫২ সালে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের বিষয়টির প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন করে। ইউরোপের দেশগুলো এবং নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা জীবন ধারনের অধিকার, স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকারের মতো মৌলিক মানবাধিকার ধারণার সাথে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারকে সমমর্যাদায় স্বীকৃতি দিতে দ্বিমত পোষণ করেন। বিরোধীদের মধ্যে বেশিরভাগই তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের ধারণার প্রতি সন্দেহ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
১২. এদেশে আমরা দেখি বিশ্বব্যাংক এবং ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগী সংস্থা ওইসিডি ইতিমধ্যেই বেশ পরিস্কারভাবেই জানিয়েছে টেকসই বা স্থায়ী উন্নয়নের পথ আমাদের বেছে নিতেই হবে৷ শুধুমাত্র টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমেই প্রকৃতি, পরিবেশ এবং সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব৷ আর তা হলেই ব্যবসা এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি আশা করা যেতে পারে৷ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা যেতে পারে৷ তবে এসব পরিবেশ বাস্তবায়নের ক্ষমতা দরিদ্রদেশগুলোর নেই৷ দূর্বল দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষেরই এ বিষয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই৷ তারা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত৷ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাপ ছাড়াও সন্ত্রাস এবং বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হয় তারা প্রতিনিয়ত৷ তাই এদের সাহায্য এবং সহযোগিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি৷ মর্যাদাসম্পন্ন একটি কাজ, যে কাজের সুবাদে একটি মানুষ তার পরিবারকে নিয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম – তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ প্রতিটি মানুষের বেলাতেই একই কথা প্রযোজ্য৷ সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে প্রতিটি মানুষকে – কারণ এই প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত হয়েছে ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে৷ সেই ঘোষণাপত্রেই সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা নিশ্চিত করা হয়েছে সব মানুষের জন্য৷ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে তাই প্রশ্ন হলো, বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটছে কতটুকু? সারা বিশ্বেই মানবাধিকার পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।
১৩. এবার মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রটি পাঠ করা যেতে পারে। সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়-বিচার ও শান্তির ভিত্তি; যেহেতু মানবিক অধিকারসমূহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কাযর্কলাপে পরিণতি লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে যেখানে মানুষ বাক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভয় ও অভাব থেকে নিষ্কৃতি ভোগ করবে; যেহেতু চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করা না হলে মানবিক অধিকারসমূহ অবশ্যই আইনের শাসনের দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত; যেহেতু জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করা অবশ্যক; যেহেতু জাতিসংঘভুক্ত জনগণ সনদের মাধ্যমে মৌল মানবিক অধিকারসমূহ অধিকারসমূহ, মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী ও পুরুষের সম-অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও ব্যাপকতর স্বাধীনতা উন্নততর জীবনমান প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢপ্রতিজ্ঞ; যেহেতু সদস্যরাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের সহযোগিতায় মানবিক অধিকার ও মৌল স্বাধিকারসমূহের প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা ও মান্যতা বৃদ্ধি অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ; যেহেতু সকল অধিকার ও স্বাধিকারের ব্যাপারে একটি সাধারণ সমঝোতা উক্ত অঙ্গীকার সম্পূর্ণরূপে আদায় করার জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ; তাই সাধারণ পরিষদ সকল জাতি ও জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির একটি সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে জারি করছে এই মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র; ঐ লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ মানবিক অধিকারসমূহের এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্রটিকে সর্বদা স্মরণ রেখে শিক্ষাদান ও জ্ঞান প্রসারের মাধ্যমে এ সকল অধিকার ও স্বাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে জাগ্রত করতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রগতিশীল ব্যবস্থাদির দ্বারা সদস্য-রাষ্ট্রসমুহের জনগণ ও তাদের অধীনস্থ অঞ্চলসমূহের অধিবাসীবৃন্দ উভয়ের মধ্যে ঐগুলোর সর্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি ও মান্যতা অর্জনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাবে৷’
১৪. অনুমোদন : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের উপর সার্বজনীন ঘোষণার খসড়া সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ৪৮ ভোট পড়ে এবং বিপক্ষে কোন ভোট পড়েনি। কিন্তু ৮টি দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে। দেশগুলো হলো - সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউক্রেন, বেলারুশ, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চেকোস্লোভাকিয়া এবং সৌদী আরব।
১৫. যাদের হয়ে প্রতিবাদ করার কেউ নেই, অত্যাচারিত হলে,অন্যায় অবিচার হোলে তাদের হয়ে কথা বলবে, প্রতিবাদ করবে বলেই গঠিত হয়েছিল মানবাধিকার কমিশন। মানবাধিকার সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন-সহযোগী, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সবাইকে কার্যকর ভূমিকা পালনে মানবাধিকার কমিশন আরো বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী। সবশেষে স্মরণ করছি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধান মানবাধিকার ঘোষণা দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হওয়ায় ভারতের সংবিধানের প্রণেতা বাবাসাহেব আমবেদকারের নিম্নোক্ত মন্তব্যটি যথাযথ প্রমাণিত হয়েছে : ‘The Declaration of the Rights of Man ... has become part and parcel of our mental make up... these principles have become the silent immaculate premise of our outlook.’ আর তাই এই ঘোষণার প্রভাবকে এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই। (তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ইন্টারনেট।)
বিশেষ কৃতজ্ঞতা : জনাব খায়রুজ্জামান কামাল (Khairuzzaman Kamal), নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)।
আবদুল্লাহ আল মোহন
১০ ডিসেম্বর ২০২৪