আপনি কি লগআউট করতে চান

"বন্ধুত্বের কারণ ও সংজ্ঞা কি?

বন্ধুত্ব নানাবিধ কারণে, নানান বয়সীর সাথে হতে পারে। সংজ্ঞায়িত করতে গেলে অনেক আভিধানিক শব্দের ঝনঝনানি শুনতে হয়। এটা একটি বড় সমস্যা। আমি সহজ সরল শব্দে আনন্দ বেশী পাই। 
ছেলে বেলায়,  তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আমাদের টিভি ছিলনা। শুধু আমাদেরই না, আমাদের মহল্লার একটা লেনে বায়ান্নটা বাড়ী। টিভি আছে মাত্র তিনটা বাড়ীতে। তখন সাদা-কালোর যুগ। টেলিফোন ছিল মাত্র একটা বাড়ীতে। তখন বন্ধুত্ব ছিল খেলার সাথী,  দুষ্টুমি - বাদরামীর সাথীরাই। সেখানেও বিভাজন ছিল। তখন টিভিতে টারজান নামের ইংরেজী সিরিয়াল হতো। আমরা দল বেঁধে এর বাড়ী ও বাড়ী টারজান দেখতে যেতাম। তখন বিদ্যুৎ দিনে থাকতো কি-না মনে নেই, তবে রাতে আসতো আর যেত। মহল্লায় বিদ্যুৎ না থাকলে পাশের মহল্লায় দল বেঁধে ছুটাতাম টারজান দেখতে। কারও বাড়ীর ঘরের ভিতরে স্থান হতো না, বাড়ীর বারান্দা,  ওঠোন, ঘরের দরজা বা জানালায় হতো  আমাদের স্থান।  সবার উচ্চতা এক না হওয়ায় জানালা বিড়ম্বনা ছিল বেশ। তখন পায়ের নীচে একটা ইটে যে দু’তিনজনের দলটা থাকতাম, তাঁদের মনে হত সব থেকে প্রিয় বন্ধু।  এভাবে দল বেঁধে টারজান দেখারা ছিলাম টারজান বন্ধু। এই বন্ধুর দলটা ছিল সব থেকে বড়।
বিকেলে খেলের বন্ধু ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এক এক সময় এক এক খেলা। তবে বৃষ্টির দিনে ফুটবল খেলায় ছিল আরও একটি বড় বন্ধুর দল। এরা ছিল ফুটবল বন্ধু।  যদিও মাঝে মাঝে ফুটবলের চাঁদা দিতে না পারায় সেই দল থেকে বাদ যেতাম অনেকেই। মন মরা হয়ে সাইডলাইনে বসে বসে খেলা দেখতাম শুধু।  সেই সময় যে বন্ধু বলতে- ও আমার চাঁদায় খেলুক। সেটা ফুলটাইম হোক,  হাফ টাইম হোক বা শেষের দশ মিনিক হোক। সেই হতো সব থেকে প্রিয় বন্ধু।  মাঝে মাঝে এমনও হতো- কোন বন্ধু হয়তো খেলতে খেলতে ব্যাথা পেয়েছে, ও আর খেলবে না আজ। তখন ওর দিকে সাইড লাইনে বসা সবাই করুন মুখে তাকাতাম। এমন সময় যে আমার নাম ডাকতো তাঁকে তো প্রিয় থেকেও বড় বন্ধু মনে হতো।
আমাদের একটা খেলা ছিল, লাল লাল খেলা। এই খেলায় কোন চাঁদা লাগতো না। তখন আমাদের রাস্তা গুলো পিচঢালা ছিল না। ইট বিছানো রাস্তা ছিল। পরে জেনেছি এই রাস্তাকে বলে - হেরিংবোন বন্ড রাস্তা। এই রাস্তায় লাল লাল ইট বিছানো। আমাদের খেলের উপকরণ বাঁশের চেড়া বা চটি এবং লাল লাল ইট। লাল লাল ইট সহজলভ্য হলেও বাঁশের চটি বেশি সহজলভ্য ছিল না। তবে সে সময় বিভিন্ন বাড়ীর সামনে বাউন্ডারি দেয়া হতো বাঁশের চটি দিয়ে। যসকে বাঁশের বেড়া বলতো। আমাদের কাজ ছিল সেই সব বাড়ী থেকে বাঁশের চটি চুরি করা। "চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না খায় ধরা" এই বাক্যটি তখনই জেনেছি। আমাদের কোন কোন বন্ধু এই কাজে পারদর্শী ছিল। চোখের পলকে ছুমন্তর ছু করেই বেড়া থেকে চটি টেনে নিতে পারতো। আমরা দূরে দাড়িয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতা। যাঁরা এই কাজ করতে পারতো না তাঁদের দশ পয়সা বা বিশ পয়সা ইনভেস্ট করতে হোত। সেটা এই সময়ের বিবেচনায় খুবই নগণ্য হলেও ঐ সময় কিন্তু নগণ্য ছিল না। তখন দশ পয়সায় একটা আইসক্রিম খাওয়া যেত! দুই রংয়ের আইসক্রিম। তখন যে বন্ধু চটা ফ্রীতে দিত সে হতো প্রিয়তম বন্ধু। 
বন্ধুদের এমনি নানা দল ছিল তখন।
সেই সময়, আমাদের এক বন্ধু মহল্লা ছেড়ে চলে যাবে। ওর বাবার বদলি হয়েছে। এটা শোনার পর, টারজান দেখতে গেলে ওকে সব থেকে সুবিধাজনক স্থানটা দিতাম সবাই, ফুটবলে চাঁদা না দিলেও ওকেই কেপ্টেন বানাতাম, বাঁশের চটি ওকেই সবাই দিতে চাইতাম। সে এক প্রতিযোগিতা! ও চলে যাবার পর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেছি অনেক দিন,  কিন্তু কেউ স্বিকার করতাম না।
এরপর বড় হলাম। স্কুল বন্ধু হলো। কলেজ বন্ধু হলো। আমার আবার নাটকের বন্ধুও ছিল। তখন বন্ধুত্ব মহল্লা থেকে মহল্লায় ছড়িয়ে গেল। এমনকি শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় বন্ধু তৈরী হলো। কিন্তু মহল্লার বন্ধুদের মত এমন বন্ধু কি পেয়েছি? এই প্রশ্ন এখন পঞ্চাশ পেরুন আমি খুঁজে ফিরি!
এখন বন্ধুত্ব হয় রাজনৈতিক মতাদর্শের। মহল্লার বন্ধুদের মাঝেও আগের মত বন্ধু বা বন্ধুত্ব নেই। রাজনৈতিক ভাবধারায় বন্ধু,  প্রিয় বন্ধু,  প্রিতম বন্ধু খুঁজি সবাই।
এক সময় শুনতাম অর্থ বন্ধুত্বের মধ্যে দূরত্ব তৈরী করে। এখন আমার অভিজ্ঞতায় সেটি খুব বেশী না যতটা রাজনৈতিক দর্শনগত কারণে ঘটে। এই যে সময় আমরা পার করছি,  ২০০৭ তে এমন একটি সময় এসেছিল। এখন আবার এসেছে। রাজনৈতিক দর্শনগত কারণে আমাদের বন্ধু করতে হচ্ছে,  বন্ধু ছেড়ে দিতে হচ্ছে।  এখন আর চোখ ভেজে না। লুকিয়ে কাঁদতে হয়না। সেই কান্না লুকাতেও হয় না।
এখন অনেক বেশী প্রেম রাজনৈতিক দর্শনের সাথে।
বন্ধুত্ব রাজনৈতিক আদর্শের সাথে। এখন আর মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব হয় না।"
এই পর্যন্ত পড়ার পর চোখে ঝাপসা দেখছে রাহুল। রাহুল হচ্ছে- মহল্লা ছেড়ে যাওয়া সেই বন্ধু। যার বাবার বদলি হয়েছিল। ওর চোখের কোনে শিশিরবিন্দুর মত জল জমেছে। রাহুল ডায়রি পাতা উল্টাতে থাকে, ওর চোখে এখন আর কিছুই দেখতে পায় না। ও পাতা উল্টাতে থাকে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে রাহুল ফিরে যেতে যায় অতীতে...

© ২০২৪ লেখারপোকা | সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত

ট্রেড লাইসেন্স ঃ TRAD/DSCC/217680/2019